রসুনের ইতিহাস ও উপকারীতা এবং ব্যবহারবিধি

রান্নাঘরের অতি পরিচিত রসুন ভেষজ পরিপূরক হিসেবে আজ বিশ্বে অতি জনপ্রিয় একটি নাম। বিক্রিতে এর স্থান দ্বিতীয় হলেও গবেষণা ও আলোচনায় সম্ভবত এটি এক নম্বরে। ইতিমধ্যে ১,২০০ চিকিত্সা ও ভেষজশাস্ত্রীয় প্রতিবেদন এবং ৭০০ আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে এর গুণপনা প্রকাশিত হয়েছে। এ সবকিছু রসুনকে এককথায় মহৌষধ বানিয়ে ছেড়েছে। রসুন কিন্তু আদিযুগ থেকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যবহারিক ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হত।

রসুনের ইতিকথা

রান্নাঘরের সঙ্গে রসুনের বন্ধন হাজার হাজার বছরের পুরনো। মধ্য এশিয়ার আদি নিবাস ছেড়ে রসুন দ্রুত গতিতে ভুমধ্যসাগর পেরিয়ে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিল। তার পর চীন হয়ে পূর্বদিকে ও ভারত হয়ে দক্ষিণমুখী যাত্রা, সবই আজ ইতিহাস। প্রতিক্ষেত্রেই রসুন কিন্তু খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সা সামগ্রীর সম্মান পেয়েছে। মধ্য প্রাচ্যের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী তীরবর্তী মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ানদের কাছে রসুনের প্রথম লিখিত ইতিহাস পাওয়া গেছে। ইজিপ্টেও রসুনের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। খিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে ফ্যারাওদের সমাধিসৌধে রসুনের সন্ধান পাওয়া গেছে। চিয়পসের পিরামিডে খোদাই করা লেখা থেকে জানা যায়, পিরামিড নির্মাতারা বিশ্বাস করতেন যে রসুন খেলে শরীরে বাড়তি বল পাওয়া যায়। ইজিপ্টে যেবার নীল নদের বন্যায় সমস্ত রসুন খেত প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, সেবার প্রথম ক্রীতদাস বিদ্রোহ হয়। শ্রমিকরা এক বছর রসুন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে লেখা ‘এবারস কোডেক্স’-এ ২২টি বিভিন্ন চিকিত্সা সংক্রান্ত আলোচনায় স্পষ্টভাবে রসুনের উল্লেখ আছে। প্রাচীন ইজরায়েলের বাসিন্দারাও রসুনভক্ত ছিলেন। প্রাচীন হিব্রু লেখকেরা নিজেদেরকে ‘রসুনসেবী’ হিসেবে অভিহিত করতেন। এমনকী বাইবেলও পিছিয়ে নেই। খ্রিস্টানদের এই পবিত্র গ্রন্থে ইহুদিদেরকে রসুন নিয়ে খেদোক্তি করতে শোনা গেছে।

মধ্যযুগে চিকিৎসা বিষয়ক দুটি বই লিখেছিলেন জার্মান দেশের Bingen–এর সন্ন্যাসিনী সেন্ট হিলডেগার্ড। তিনিও রসুনের উপকারীতার কথা স্বীকার করেছেন। ১৬৬৫ সালে লন্ডনের বিখ্যাত প্লেগ মহামারীর সময় ‘দি লন্ডন কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস’ রসুন ব্যবহারের সুপারিশ করেছিলেন। বিখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক সিডেনহ্যাম গুটিবসন্ত সারাতে রসুন ব্যবহার শুরু করেন। ১৮৫৮ সালে লুই পাস্তুর জানিয়েছিলেন, রসুনের জীবানু মারার ক্ষমতা রয়েছে। বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে অ্যালবার্ট শোয়েইজার আফ্রিকায় টাইফয়েড ও কলেরা সারাতে রসুন ব্যবহার করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে যুদ্ধে আহতদের ক্ষতস্থান ও আমাশা সারাতে রসুনের বিরাট ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটকের অভাবে রসুনকে ‘রাশিয়ান পেনিসিলিন’ বলা হত। আহত সৈনিকদের ক্ষত সারাতে সে সময় রসুনের তুলনা ছিল না। ১৯৯৩-৯৪ সালে উত্তর আমেরিকার সমসাময়িক ভেষজের ওপরে করা একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভেষজের মধ্যে রসুন সপ্তম স্থান পেয়েছে। এটা কিন্তু বিক্রয়গত বিচারে নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্গত পেশাগত চিকিৎসক, নিউরোপ্যাথ, আয়ুর্বেদজ্ঞ, আকুপাংচারিস্ট, ইত্যাদিদের নিদান দেখে এই সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল।

রসুন কী?

রসুনের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালিয়াম স্যাটিভাম (Allium Sativum)। মূলত মধ্য এশিয়ার বাসিন্দা রসুন আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। সারা বছর ধরে রসুনের চাষ হয়। রসুন গাছ সাধারণত দুই ফুট বা ততোধিক লম্বা হয়। রসুনের আসল অংশটি থাকে মাটির তলাকার স্থুলাকৃতি কন্দের মধ্যে। প্রতিটি কন্দে ৪ থেকে ২০টি কোয়া থাকে। প্রতিটি কোয়ার গড় ওজন ১ গ্রাম। রসুন গাছের কাঁচা ও শুকনো কন্দ এবং নির্যাস ওষুধের জন্য ব্যবহার করা হয়। শুকনো কোয়া থেকে বানানো হয় রসুনের পাউডার। বিভিন্ন রসুনে সব উপাদান সমপরিমাণে থাকে না। এটা নির্ভর করে রসুনটি কোথায় এবং কীভাবে চাষ করা হয়েছে তার ওপর। প্রকৃতপক্ষে কাঁচা রসুন ও ব্যবসায়িকভাবে জাত রসুন পরিপূরকগুলিতে অ্যালিসিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহের ফারাক অনেকটা। বর্তমানে বিশ্বে কমপক্ষে পাঁচটি প্রজাতির রসুনকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত রসুনে সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ এতটাই কম যে তা সঠিকভাবে কোলেস্টেরল কমাতে, রক্ত চাপের উন্নতি ঘটাতে এবং সঠিকভাবে সংক্রমণ রুখতে পারে না। দীর্ঘদিনের জন্য সংরক্ষণ করতে রসুনের সন্ধান বা ফারমেন্টেশন ঘটানো হয়, যার ফলে রসুনের উপকারী উপাদান ভেঙে যায়। এ ছাড়াও উচ্চচাপে রান্না করলে রসুনের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। সব চেয়ে ভাল, সঠিক মানের রসুনজাত দ্রব্য ব্যবহার করা, যার মধ্যে নির্দিষ্ট মানের অ্যালিসিন ও অন্য উপাদান থাকে।

রসুনের রসায়ন

প্রকৃতিতে রসুনের মধ্যে রয়েছে অ্যালীন বা এস-অ্যালাইল-এল-সিস্টিন সালফোক্সাইড নামে সালফার যুক্ত অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং প্রচুর পরিমাণে একাধিক সালফার জাতীয় যৌগ। গন্ধবিহীন অ্যালিন রসুনের আপাতনিষ্ক্রিয় স্থিতিশীল যৌগ। রসুনকে থেঁতো করলে বা রসুনের কন্দের ছাল ছাড়িয়ে তার কোষ প্রাচীর ভাঙলে তার থেকে বের হয় অ্যালিনেজ নামে একটি উৎসেচক। এই উৎসেচকের প্রভাবে অ্যালীন রূপান্তরিত হয় অ্যালিসিন বা ডাই অ্যালাইল থায়োসালফিনেট-এ। অ্যালিসিন যৌগটি আবার অ্যাজোয়িন-সহ বহু অর্গানোসালফিউরিক যৌগের পূর্বসূরী। বাষ্পীয় পাতন বা তেলে চোবানো অবস্থায় অ্যালিসিন বহুবিধ ডাই অ্যালাইল ও ডাইমিথাইল সালফাইড তৈরি করে।

জীবদেহে রসুনের কাজ কী?

বিভিন্ন গবেষণায় রসুনের শারীরবৃত্তীয় উপকারীতা প্রসঙ্গে যে তথ্য সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হল, রসুন-

  • সামান্য পরিমানে রক্তচাপ কমায়
  • সামান্য পরিমানে এল ডি এল কোলেস্টেরল কমায়। সম্ভবত লিভারে এল ডি এল কোলেস্টেরল তৈরি করতে বাঁধা দেয়
  • ধমনীর মধ্যে অ্যাথেরোস্ক্লেরেটিক নির্মান কমায়। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির হরমোনের পার্থক্যের জন্য ছেলেদের থেকে মেয়েদের ক্ষেত্রে রসুনের কার্যকারিতার হার বেশি
  • রক্ত শর্করার মাত্রা কমাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে
  • রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। স্ট্রোক ও থ্রম্বোসিসের সম্ভাবনা কমায়
  • ক্যান্সার, বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সারে বাধা সৃষ্টি করে। কিছু কিছু টিউমারকে বাড়তে দেয় না। আবার কিছু কিছু টিউমারের আয়তন ছোট করে দেয়
  • কাঁচা অবস্থায় রসুন একটি কার্যকরী প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিকের তুলনায় যথেষ্ট কম শক্তিশালী হয়েও আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এ রকম কিছু জীবানু (ব্যাকটিরিয়া) বিনাশ করতে সক্ষম
  • ছত্রাক ও ভাইরাস বিনাশী ধর্মের অধিকারী। খেলোয়ারদের পায়ের ছত্রাক সংক্রমণ সারিয়ে তোলে
  • ক্যানডিডা প্রজাতির (ইস্ট) ছত্রাক আক্রমনকে নাটকীয়ভাবে সারিয়ে তুলতে পারে
  • শরীর থেকে সিসা বা লেড ও পারদ বা মার্কারির মতো ভারী ধাতু বের করতে সাহায্য করে
  • অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রূপে কাজ করে
  • সেলেনিয়ামের একটি প্রাকৃতিক উত্স
  • সম্ভবত আরও অনেক উপকার করার ক্ষমতা আছে, যা আজও অনাবিস্কৃত

রসুন কীভাবে ব্যবহার করব?

রোগ সারাবার আশ্চর্য ক্ষমতা হাজার হাজার বছর ধরে রসুনকে ‘বিস্ময় ওষুধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জীবানুনাশক বলে রসুনকে ‘রাশিয়ান পেনিসিলিন’ও বলা হয়। তবে পেনিসিলিয়ামের চেয়েও এর একটা বড় ও বাড়তি সুবিধা হল স্বাভাবিক তাপমাত্রায় একে অনেক বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়। ‘মেডিক্যাল হার্বালিজম অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন’ পত্রিকার সম্পাদক ও কলোরাডোর রকি মাউন্টেন সেন্টার ফর বোটানিক্যাল স্টাডিজ-এর ফ্যাকাল্টি সদস্য ডঃ পল বার্গনার মনে করেন, রসুন একটি বহুমুখী, শক্তিশালী এবং ফলদায়ী খাদ্য পরিপূরক ও ওষুধ, যা বিপুল সংখ্যক সাধারণ অসুখ সারাতে পারে। যে অসংখ্য গুণে রসুন গুণান্বিত তারই কয়েকটা নিয়ে নিচে আলোচনা করছি-

জীবানু ধ্বংসকারী ক্ষমতা: সংক্রামক জীবানুদের আক্রমণের হাতিয়ার হল অ্যালকোহল ডিহাইড্রোনেজ ও সিস্টিন প্রোটিনেজ নামের উৎসেচক। ওয়েজম্যান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা পরজীবী প্রোটোজোয়া এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকার ওপরে যে গবেষণা করেছেন তা ‘বায়োকিমিকা বায়োফিজিকা’ নামের গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁরা বলেছেন, অ্যালিসিন তার মধ্যেকার সালফহাইড্রিল মূলক বা থায়লস-এর সহায়তায় এই উৎসেচকগুলিকে নিস্ক্রিয় করে জীবানু সংক্রমণে বাধা দেয়। এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেই গবেষণাগারে অ্যালিসিনের সাহায্যে এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।

রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: সালফাইড্রিল মূলক বা থায়লস-এর আর একটি কাজ হল শরীরের কোলেস্টেরল সংশ্লেষণে সাহায্য করা। ওয়েজম্যান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা লিখছেন- ‘প্রচলিত ধারণা হল যে, রসুন রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। আমাদের গবেষণার মাধ্যমে এটা কীভাবে ঘটে তার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।’ আসলে রসুনের ভেতরকার ডাইসালফাইডস লিপিডের থ্রি-হাইড্রক্সি-থ্রি-মিথাইলগ্লুটারিল- কোএনজাইম এ রিডাকটেজের সঙ্গে সালফাইড বন্ধন তৈরি করে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির জৈব-রসায়ন বিভাগের ডিন ডাঃ মির উইনচেকের মতে, ধমনী মধ্যস্থ রক্তকে জমাট বাঁধায় বাধা দানকারী অ্যালিসিনের ভূমিকা নিয়ে আরও বৃহত্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।

রক্ততঞ্চনে বাধাদান: আজ এটা প্রতিষ্টিত য়ে রসুন থ্রমবোক্সিন সংশ্লেষনের মাধ্যমে অনুচক্রিকার কাজকে সঠিকভাবে করতে দেয় না। অনুচক্রিকা হল রক্তের মধ্যেকার অতিক্ষুদ্র গোলাকার একটি উপাদান যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। রসুনে উপস্থিত মিথাইলঅ্যালাইল ট্রাই সালফাইড বা এম এ টি এস ও অ্যাজোয়িনস-এরও অ্যান্টিথ্রম্বোটিক সক্রিয়তা আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়া: রসুন শরীরের ক্যাটালেজ ও গ্লুটাথিয়ন পারক্সিডেজ নামে দুটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উত্সচেকের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উত্সেচক বাড়ায়, ফলে শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি-র‍্যাডিক্যাল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

শর্করা হ্রাসের ক্ষমতা: এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যে ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য পরিপূরক হিসেবে রসুন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ইঁদুর, খরগোশ ও নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের ওপরে করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, রসুনের নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের অ্যান্টিডায়াবেটিক ধর্ম আছে। রসুন রক্তে ইনসুলিনের ঘনত্ব ও লিভারে গ্লাইকোজেন মজুত করার ক্ষমতা বাড়াতে পারে। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ডায়াবেটিস (টাইপ-২) রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে রসুন খুব বেশি কাজ দেয়। রসুনের এস-অ্যালাইলসিস্টিন সালফোক্সাইড যৌগ এ জন্য দায়ী।

রক্তনালির নমনীয়তা বজায় রাখা: এন্ডোথেলিয়াম-জাত কিছু কিছু পদার্থের (যেমন নাইট্রিক অক্সাইড) কার্যকারিতা ধমনীর দেওয়ালের নমনীয়তার ওপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। তাই মানুষের শরীরের কোষ কলায় রসুন নির্যাস ব্যবহার করলে ধমনীর নমনীয়তা বাড়ে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ: ক্যান্সার সারাতে নয়, ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা পেতে বর্তমানে রসুনের প্রয়োগ হচ্ছে। জনতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, রসুনসেবীদের ক্যান্সার কম হয়। ১৯৮১ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, চীনদেশি রসুনসেবীদের মধ্যে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা, যাঁরা রসুন খান না তাঁদের থেকে অনেক কম। ১৯৯৪ সালের অন্য একটি সমীক্ষায় ইতালি ও লোওয়াতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। ১৯৮৫ সালের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা গেছে, রসুন ক্যান্সার কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে। তার ফলে আদতে গোটা পদ্ধতিটির গতিমুখের পরিবর্তন ঘটে। পেনস্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, অ্যালিসিন ভেঙে গিয়ে এস-অ্যালাইল সিস্টিন নামে জলে দ্রাব্য রাসায়নিক তৈরি করে, যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষগুলিকে নির্মূল করে বা বিভাজন গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি গবেষণা জানাচ্ছে, তেলে দ্রবণীয় ডাইঅ্যালাইল ডাইসালফাইড (ডি এ ডি এস) এবং ডাইঅ্যালাইল ট্রাইসালফাইড (ডি এ টি এস) একইভাবে ফুসফুস, ত্বক ও কোলন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাড়তি সালফার পরমাণুর কল্যাণে ডি এ টি এস-এর ক্ষমতা ডি এ ডি এস-এর চেয়ে অধিক। যেহেতু বেশ কিছু ক্যান্সার কোষ শরীরের রক্তের পরিবর্তে লিম্ফ সংবহনতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়, তাই তেলে দ্রাব্য ডি এ টি এস বা ডি এ ডি এস-এর কাজে সুবিধা হয়। অন্য দিকে জলে দ্রাব্য বলে এস এ সি লিম্ফ সংবহনতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ক্যান্সার কোষের ওপরে হামলা চালায়। এই দ্বিমুখী আক্রমণ ক্ষমতা রসুনকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে সন্দেহ নেই। উচ্চ মাত্রার সেলেনিয়ামের উপস্থিতি রসুনকে অ্যান্টি-টিউমার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ক্ষমতা দিয়েছে। আরও দেখা গেছে, রসুন প্রস্টেট ও গলার ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে। এ ছাড়াও গবেষণাগারের পরীক্ষায় জানা গেছে, রসুনের ডাই অ্যালাইল সালফাইড এবং অ্যালাইল মিথাইল সালফাইড, সাইটোক্রোম পি৪৫০২ই১ প্রোটিনকে নষ্ট করে ক্যান্সার কোষ দমন ও ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা রোধ করতে সক্ষম। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ডাঃ হার্বাটের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- রসুন নিজেই প্রকৃতপক্ষে একটি প্রামাণ্য ভেষজপঞ্জি। সেই কারণেই প্রতিটি সভ্যতার প্রতিটি চিকিত্সা সংক্রান্ত পুস্তকেই রসুনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর ধরে রসুন ওষুধ হিসেবে ও অসুখ থেকে আগাম সুরক্ষা পেতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

অ্যাথেরোস্ক্লেরেসিস নিয়ন্ত্রণ: রক্তনালিতে ডেলা পাকানো অবস্থার রক্ত ও প্লেক মিলিতভাবে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে থাকে। ফলে, অ্যাথেরোস্ক্লেরেসিস দেখা দেয়। হার্ট, মস্তিস্ক ও পায়ে ঠিকমতো রক্ত প্রবাহিত না হলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক অথবা পেরিফেরাল ডিজিজ (পি ভি ডি) হতে পারে। যাঁরা পি ভি ডি-তে ভুগছেন তাঁরা নড়াচড়া বা হাঁটাচলা করলে পায়ে ব্যথা অনুভব করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচা রসুন বা রসুন পরিপূরক রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না ও প্লেক ধ্বংস করে। বিভিন্ন প্রাণীর ওপরে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, রসুনের হোমোসিস্টিন কমাবার ক্ষমতা আছে। কোলেস্টেরলের মতো হোমোসিস্টিনও অ্যাথেরোস্ক্লেরেসিস গঠনের আরও একটি অতি প্রয়োজনীয় কারিগর।

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, বেড়ে যাওয়া কোলেস্টেরল মাত্রাকে রসুন কিছুটা পরিমান কমাতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত কিছু বলার সময় হয়নি। কারণ, এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে গবেষণা চলছে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: কোলেস্টেরলের মতোই উচ্চ রক্তচাপকে রসুন কিছু পরিমাণে কমাতে পারে। এটাও এখনও গবেষণাধীন। তবে যেহেতু রসুনের রক্তকে তরল করার ক্ষমতা রয়েছে, তাই একজন ভেষজ বিশেষজ্ঞ উচ্চ রক্তচাপে রসুনের সুপারিশ করতেই পারেন।

টিউবারকুলোসিস নিয়ন্ত্রণ: বিভিন্ন গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা গেছে, গাঢ় ঘনত্বের রসুন নির্যাস যক্ষ্মা সৃষ্টিকারী মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস-এর বৃদ্ধি আটকাতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মত পোষণ করেন যে, অত গাঢ় রসুন নির্যাস মানব শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক (বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে)। প্রাণীদেহের ওপর করা কয়েকটি পরীক্ষায় অবশ্য বেশি ঘনত্বের রসুন তেল কোনও খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি, অথচ মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস ব্যাকটিরিয়াকে নিবৃত করে ফুসফুসের যক্ষ্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। আধুনিক কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, রসুন নির্যাস বা রসুন তেলের সঙ্গে অ্যান্টি-টিউবারকুলোসিস ওষুধ মিলিতভাবে প্রয়োগ করলে বেশি ভাল পাওয়া যায়। উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য রসুনের অ্যালাইল মার্কাপটান যৌগ দায়ী, যা আবার কোলেস্টেরল কমায়। অ্যাথেরোস্ক্লেরেসিস তৈরি করতে বাধা দেয়, রক্ত শর্করা ও টিউমার প্রতিরোধ করে। রসুনের আর্গিনাইন যৌগ শরীরকে গরম রাখে ও রক্তনালিকার স্থিতিস্থাপকতা বাড়িয়ে রক্ত চলাচলকে উন্নত করে।

অন্ত্রের পরজীবী নিয়ন্ত্রণ: গবেষণাগারের পরীক্ষায় বিভিন্ন বিজ্ঞানী কাঁচা রসুনের অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ধর্ম লক্ষ্য করেছেন। এরা অ্যাসকারিস লামব্রিকোইডস জাতীয় কৃমিও দমন করতে পারে। যদিও পরীক্ষাটি এখনও মানুষের ওপরে করা হয়নি।

বিপর্যয়ে জরুরি চিকিৎসায়: রসুনকে প্রকৃতিপ্রদত্ত ওষুধের ভাঁড়ার ঘর বলা যেতে পারে। প্রতিটি পরিবারের প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্সে রসুনকে অবশ্যই রাখা উচিত। প্রাথমিক চিকিৎসায় বা জরুরি প্রয়োজনে রসুন ব্যবহারের আগে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভাল যে, আমি কোনও চিকিৎসা সংক্রান্ত উপদেশ দিচ্ছি না। আমি শুধু এ যাবৎকাল রসুনের গবেষণায় গবেষকেরা যে-সব তথ্য জানতে পেরেছেন, একজন বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে সেই সব তথ্যকে সহজবোধ্য ভাবে জনসাধারণের জন্য (তথ্য জানার অধিকার বা রাইট টু ইনফরমেশন) পরিবেশন করছি। সংগঠিত চিকিৎসক দল আসার আগে বিপর্যয় কবলিত মানুষদের যদি এই তথ্যপঞ্জী কোনওভাবে উপকারে আসে তবেই এই প্রতিবেদনের স্বার্থকতা। ভূমিকম্প, বন্যা বা সুনামি পরবর্তী বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে আহত মানুষদের আপৎকালীন চিকিৎসায় রসুন ব্যবহার করা যেতে পারে। থেঁতো করা রসুন একটি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক। তবে এগুলিকে অবশ্যই ক্ষতের চারধারে লাগাতে হবে। লাগাবার পর প্রথম কয়েক মিনিট আগুনে পোড়ার মতো অনুভুতি হলে বুঝতে হবে স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে রসুনের কার্যকরী উপাদানগুলির বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। শুধু স্ট্যাফাইলোকক্কাস নয়, স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটিরিয়া খতম করতেও রসুনের জুড়ি মেলা ভার। ইজরায়েলের রেহোভেক শহরের উইজম্যান ইনস্টিটিউটের ডঃ ডেভিড মিরেলম্যান জানাচ্ছেন, অ্যালিসিন যৌগটি স্ট্যাফাইলোকক্কাস ও স্ট্রেপটোকক্কাস-সহ অন্য ব্যাকটেরিয়াদের প্রথমে ফোলায়, তার পরে ফাটিয়ে ফেলে নিকেশ করে। আধুনিক চিকিৎসায় যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় স্ট্যাফাইলোকক্কাস তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও রসুনের কাছে এরা কাবু। ব্যাকটিরিয়া বিধ্বংসী ক্ষমতা বেশি করে পেতে হলে থেঁতো রসুন প্রয়োগের আগে ৭-১৪ মিনিট রেখে দেওয়া ভাল। এর ফলে সর্বাধিক পরিমাণে অ্যালিসিন তৈরি হবে। গবেষকরা দেখেছেন, রসুন এইচ আই ভি প্রোটিয়েজ উৎসেচক নষ্ট করার কিছু ক্ষমতা রয়েছে। গবেষকরা এও মনে করছেন যে, রসুন কোলেস্টেরল কমাবার ওষুধ স্ট্যাটিন (স্ট্রোভাসট্যাটিন, প্রোভ্যাস্ট্যাটিন, লোভাস্ট্যাটিন) এবং রক্তচাপ কমানোর ওষুধ (এ সি ই ইনহিবিটরস- এনাপ্রিল, ক্যাপটোপ্রিল, লিসিনোপ্রিল)-এর মতো কাজ করতে পারে। সে জন্য এটা জানা বিশেষ জরুরি যে, বেশি মাত্রায় রসুন গ্রহণ করা যায় কিনা এ নিয়ে গবেষণাও চলছে।

অনাক্রম্যতা বৃদ্ধি: রসুন শ্বেতকণিকার ন্যাচারাল কিলার সেলস এবং টি-হেল্পার সেলসগুলির কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে পারে।

অন্যান্য ব্যবহার

  • রান্না করার সময় যদি মনে হয় মাংসগুলো টাটকা নয়, তবে থেঁতো করা রসুন মাংসগুলোর গায়ে ভালভাবে মাখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এতে বহু ক্ষতিকারক জীবানুর বিনাশ সম্ভব
  • যেখানে পানীয় জল দুর্লভ, সেখানে ই কোলি জাতীয় ব্যাকটেরিয়া বা অন্য জীবানু বাহিত দূষিত জল পরিশোধন করতে রসুন ব্যবহার করা যায়। রসুন থেঁতো করে দুষিত জলে মিশিয়ে দিতে হবে। এর পর কয়েক ঘন্টা বা সারা রাত রেখে দিলে কাঙ্খিত ফল মিলবে। জলের স্বাদবদল হবে ঠিকই এবং রসুন যে উপাদানের ওপরে কাজ করতে পারে না, তা অবিকৃত থেকে যাবে সেটাও সত্যি, তবুও দূষণ যে কমবে তাতে সন্দেহ নেই
  • রসুনের অ্যান্টিবায়োটিক গুণের কথা মনে রেখে থালা, বাসনকে জীবানুমুক্ত করা যেতে পারে
  • বহুদিন ধরেই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় রসুন ব্যবহার হয়ে আসছে। থেঁতো করা রসুন কোয়া ক্ষতের চারপাশে লাগিয়ে ভাল করে মালিশ করা হয়। এই সময় মিনিট ২-৩ তীব্র জ্বালা করে। অধিকাংশ সাপের বিষ ফ্যাট/তেলে দ্রাব্য, তাই লিম্ফাটিক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। রসুনের সালফার যৌগগুলিও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। ধীরে ধীরে মালিশ করলে রসুনের সালফার যৌগসমূহ ক্ষতের চারপাশ থেকে ত্বকের মাধ্যমে শরীরে লিম্ফাটিক সিস্টেমে প্রবেশ করবে। এই সময় একটা সতর্কতার দরকার রয়েছে, নজর রাখতে হবে রোগী যেন বেশি নড়াচড়া না করে। রসুন খেয়েও উপকার মিলতে পারে কারণ, তাতে রসুনের উপাদান প্রতিষেধকগুলির সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এতে সময় লাগে অনেক বেশি। সাপের কামড় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই জরুরি মুহূর্তে রসুন হয়ত এর আদর্শ চিকিৎসা নয়, যদিও কোনও কিছু না করে হাত গুটিয়ে মরার চাইতে এই পদ্ধতির প্রয়োগে কিছুটা উপকার মিলতেও পারে
  • যদি কারও কোলনে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয় এবং যদি কাছাকাছি কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা প্রয়োজনীয় ওষুধের দোকান না পাওয়া যায় তবে রসুনের ব্যবহার করা যেতে পারে। কয়েক কোয়া রসুন রসুন থেঁতো করে মিনিট পনের রেখে দিন। এর পরে সেগুলো গরম জলে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ রেখে অপেক্ষাকৃত বড় টুকরোগুলি ছেঁকে ফেলুন। একেবারে শেষে জলসুদ্ধ সবটা খেয়ে নিলে উপকার পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে আবার কিছুক্ষণ বাদে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে
  • বন্ধ নাক, ধীরে ধীরে ফুসফুসের দিকে ধাবিত হওয়া গলা ব্যথা হলে নাকের খুব কাছে নিয়ে থেঁতো করা রসুনের গন্ধ শোঁকা যেতে পারে। এ-ক্ষেত্রে দ্রুত উপশমের সম্ভাবনা থাকে কারণ, রসুন-বাস্পগুলি সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যায়। অন্য আর একটি পদ্ধতি হল, থেঁতো রসুনকে একটি পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে নাক দিয়ে জোরে জোরে এর ভেষজ বাষ্পকে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে দেওয়া দেওয়া। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, থেঁতো রসুনের ভেষজ বাষ্প স্ট্যাফাইলোকক্কাস ও স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটিরিয়াকে নির্জীব করতে সক্ষম
  • সর্দি-বসা ফুসফুসের জন্য রসুন কার্যকর। কোলনে ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের জন্য যেমন রসুনের জলীয় মিশ্রণ তৈরি করা হয়েছিল তেমন তৈরি করে মুখে ভরে নিন। তার পরে শিস দেওয়ার মতো করে ঠোঁট ফাঁক করুন। ভিতরের হাওয়া বাইরে বের না করে মুখ দিয়ে হাওয়া টানুন। রসুনের ভেষজ বাষ্প সরাসরি ফুসফুসে গিয়ে শুকনো শ্লেষ্মা ও আক্রমণকারী জীবানুগুলিকে আলাদা করে দেবে। এর পরে কাশলেই জমাট বাঁধা শ্লেষ্মা বেরিয়ে আসতে থাকবে
  • প্রচণ্ড দাঁত ব্যথায় কোনও ডাক্তার না পেয়ে রসুন দিয়ে মুশকিল আসান করা যায়। থেঁতো করা রসুন মুখে চিবিয়ে বাকিটা ব্যথার জায়গার আশপাশে গুঁজে দিন। কয়েক মিনিট মাড়িতে জ্বলুনি বোধ করবেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তা প্রশমিত হয়ে যাবে। সাধারণত ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যায়, কমতে থাকে ফোলা ভাব। দিনে বারকয়েক এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে ব্যথা ও ফোলা থেকে স্থায়ী মুক্তি মিলতে পারে। তবে এর পরেও না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
  • দুর্গন্ধনাশক/বাষ্পশোধক রসুনের ব্যবহার হেত পারে। বাড়ি পরিষ্কার করার পরও অনেক সময় বাজে গন্ধ পাওয়া যায়। রসুন এ ব্যাপারে পারদর্শী। বেশ কিছু রসুন থেঁতো করে একটা প্লেটে রেখে দিন। কিছুক্ষণ পরে দেখবেন বাজে গন্ধ চলে গেছে
  • রিউম্যাটেড আর্থারাইটিস বা বাতের সমস্যায় ভুগছেন এমন লোকেদের ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ কমাতে রসুনের ব্যবহার হবুদিন ধরেই চালু আছে
  • সাধারণ সর্দিতে রসুন কার্যকর। একটি অত্যাধুনিক পরীক্ষায় ১৫০ জন লোককে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের ১২ সপ্তাহ ধরে রসুন বা রসুনের পরিপূরক খাইয়ে যাওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ওই কয়েকজন লোক সর্দিকাশির ক্ষেত্রে যাঁরা এ-সব ব্যবহার করেননি, সেই সব সাধারণ লোকের থেকে বেশি সুস্থ আছেন। যাঁরা একটু-আধটু সর্দিতে ভুগছেন তাঁরাও অপেক্ষাকৃত দ্রুত সেরে উঠছেন। রসুনের নির্যাস দিয়ে তৈরি একটি নাকের ড্রপ প্রয়োগ করে পশুদের ইনফ্লুয়েঞ্জায় ১০০% সুরক্ষা পাওয়া গেছে
  • অধিকাংশ শিশুরই ওটাইটিস মিডিয়ার কারণে কানে ব্যথার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সমস্যা কমাতে ব্যথা উপশমকারী ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকেরা সাধারণত কানে ড্রপও দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, কানে এই ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে রসুন, ক্যালেনডুলা, সেন্ট জনের ওয়ার্ট এবং মুলেইন ফুলের মিলিত নির্যাস ব্যবহার করে আশাতীত ফল পাওয়া যাচ্ছে
  • জনৈক গবেষকের মতে, রসুন গ্রহীতাদের নিজেদের ভালমন্দ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠে। উদ্বেগ, চাপ কমিয়ে মানসিকভাবে বলিয়ান করে তোলার মতো ক্ষমতা নিশ্চয়ই রসুনের আছে। ইতিহাসের রোমান সৈনিকেরা এমনটা বিশ্বাস করতেন বলে নিয়মিত রসুন খেতেন।

কী ব্যবহার করবেন?

সবচেয়ে ভাল ফল পেতে একেবারে টাটকা স্বাস্থ্যকর কাঁচা রসুন ব্যবহার করা শ্রেয়। মনে রাখা ভাল, অঙ্কুরিত রসুন কাঁচা হলেও কিন্তু ভাল ফলদায়ী হবে না। একইভাবে বহুদিন হল মাটি থেকে তোলা হয়েছে এবং বেশ কিছুদিন আলোর সংস্পর্শে আছে অমন রসুনকে বাদ রাখা ভাল। শুকনো নেতিয়ে পড়া রসুনও ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে পরিত্যজ্য। কারণ এর মধ্যে থাকা উৎসেচক ও অন্য উপাদানগুলির পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ থেকে যায়। ডাঃ ল্যারি লাউসন তাঁর লেখা ‘দি সায়েন্স অ্যান্ড থেরাপিউটিক অ্যাপ্লিকেশন অফ অ্যালিয়াম স্যাটিভাম’ নামে বইটিতে জানাচ্ছেন, সব রসুন সমান গুণসম্পন্ন হয় না। খাওয়ার সময় যে রসুন মুখে বেশি উত্তাপের সৃষ্টি করে তার ভেষজগুন মৃদু উত্তাপ সৃষ্টিকারী রসুনের চেয়ে বেশি। ডাঃ লাউসনের লেখা এই বইটিকে রসুন সম্পর্কিত যাবতীয় রচনাগুলির মধ্যে প্রতিনিধি স্থানীয় বলে ধরা হয়। রসুনকে পরিপূরক খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা চলে। শুকনো, রান্না করা, প্রক্রিয়াজাত বা তেলে ভেজানো রসুনে অনেক গুণই নষ্ট হয়ে যায়। সেই কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহৃত রসুনজাত পদার্থে কমপক্ষে ৬,০০০ মাইক্রোগ্রাম অ্যালিসিন থাকা দরকার। ভাল কোম্পানির পরিপূরকে এই মাত্রাটা এমনভাবে রাখা হয় যাতে পাকস্থলী পৌঁছে এটি ৬,০০০ মাইক্রোগ্রাম অ্যালিসিন মুক্ত করতে পারে। অ্যালিসিন অত্যন্ত অস্থায়ী যৌগ বলে ভাল পরিপূরকগুলিতে অ্যালিসিনের পরিবর্তে এর পূর্বসূরী অ্যালীনকে রাখা হয়।

সংরক্ষণ করবেন কীভাবে

রসুনকে ঠান্ডা, অন্ধকার ও শুকনো জায়গায় রাখা দরকার। জায়গাটি এমন হবে যেখানে ভালভাবে বাতাস চলাচল করতে পারে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখা দরকার কোনও কোয়া খারাপ হয়েছে কিনা। খুঁজে পাওয়া গেলে অন্য কোয়ার ক্ষতি না করে খারাপ কোয়াটিকে সযত্নে ফেলে দিতে হবে। ফ্রিজে সংরক্ষিত ও শুকনো রসুন সাধারণ তাপমাত্রার চেয়ে বেশি উত্তাপে বেশি দিন থাকলে গুণ হারায়। এই কারণেই মুদির দোকানে রাখা রসুন ভেষজগুণের কার্যকারিতা হারায়।

ব্যবহার বিধি ও গ্রহণ মাত্রা

অন্য খাবারের সঙ্গে অ্যালকোহলের পার্থক্য হল, অ্যালকোহলকে শরীরে শোষিত হওয়ার জন্য পৌষ্টিকতন্ত্রের খুব বেশি গভীরে যেতে হয় না। পাকস্থলী থেকেই শোষিত হয়ে এটি সারা শরীরে ছড়ায়। তাই এটি খুব কম সময়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই কথা মনে রেখে দ্রুত রসুনের উপকার পেতে প্রয়োজনীয় মাত্রার থেঁতে রসুন সামান্য ব্রান্ডি বা ওয়াইন সহকারে খাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে রসুনের তেলে দ্রবনীয় অংশগুলি থেকে উপকার পেতে থেঁতো করা রসুনকে অলিভ অয়েলের সঙ্গে মিশিয়েও খেতে পারেন। সে-ক্ষেত্রে শরীরের লিম্ফাটিক সিস্টেমের মাধ্যমে উপাদানসমূহ শরীরময় ছড়াবে। আবার থেঁতো রসুন ত্বকে ঘসলে এর সক্রিয় উপাদানগুলি ব্যাপন পদ্ধতিতে দ্রুত শরীরে প্রবেশ করবে। রসুন তেল চামড়ায় ঘষেও একই ধরনের উপকার পাওয়া যায়। এটি প্রতিষ্ঠিত যে ভিটামিন সি-র ক্যান্সার-বিনাশী ক্ষমতা রয়েছে। তাই কমলা বা আঙুর রসের সঙ্গে থেঁতো রসুন মিশিয়ে খেলেও বাড়তি উপকার পাওয়া যায়। রসুন খুবই সুরক্ষিত ভেষজ। তবে নিয়মিত গ্রহণে নিঃশ্বাস ও ঘামের থেকে দুর্গন্ধ বেরোয়। অনেকেই এই গন্ধটা পছন্দ করেন না। মজার ব্যাপার হল, শরীর থেকে গন্ধ বেরোনোর অর্থ হল রসুন কাজ করছে। গন্ধ কমাতে রসুনের সঙ্গে একটি সবুজ পাতা (যেমন পার্সলে) খাওয়া যেতে পারে। আবার রাতে রসুন খেয়ে নিয়ে সকালে স্নান করে নিলে গন্ধের তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায়। রসুন মধ্যস্থ জল প্রতি মুহূর্তেই প্রকৃতিতে শোষিত বা ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। ফলে, এর উপাদানেরও প্রতি মুহূর্তে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। রসুন গ্রহণের মাত্রা নিয়ে সে কারণেই একটা বিতর্ক রয়ে গেছে। তবুও মোটামুটি ভাবে একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রার হদিশ দেওয়া হল।

শিশু

শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণে শিশুদের ক্ষেত্রে রসুন ব্যবহার করতে হলে ভেষজ ওষুধের দ্বারা শিশুচিকিৎসায় অভিজ্ঞ কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

প্রাপ্তবয়স্ক

রসুনের গোটা কোয়া: প্রতিদিন গোটা বা কুচি করা অবস্থায় ২-৪ গ্রাম তাজা রসুন কোয়া

রসুনের ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল: ১.৩% অ্যালিন বা ০.৬% অ্যালিসিন সঠিক মাত্রায় আছে এরকম ঠান্ডা করে শুকনো করা রসুনের ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল প্রতিদিন ৬০০-৯০০ মিগ্রা

ইনফিউশন: প্রতিদিন ১৫০ মিলি জলে ৪ গ্রাম রসুনের ছাড়ানো কোয়া

নির্যাস: ১:১ (গ্রাম/মিলি) প্রতিদিন ৪ মিলি পরিমাণ। ১:৫ (গ্রাম/মিলি) দ্রবণের টিংচার প্রতিদিন ২০ মিলি

তেল: ০.০৩ থেকে ০.১২ মিলি দিনে তিনবার

আধুনিক মতামত

আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানে নতন নতুন আবিষ্কারে সনাতন ধ্যান ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বলা হচ্ছে, গ্যাস্ট্রিক আলসার, আলসারেটিভ কোলাইটিস, করোনারি আর্টারির অসুখ, কাপোসির সারকোমা এবং সার্ভিক্যাল ক্যান্সার-সহ নানা অসুখের মূলে রয়েছে ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাসের মতো জীবানু। এই অসুখগুলি থেকে উপশম ও মুক্তি পেতে রসুন সাহায্য করতে পারে। অষ্ট্রেলিয়ার রয়েল পার্থ হাসপাতালের ব্যারি মার্শাল ও রবিন ওয়ারেনের সদ্য আবিষ্কার থেকে জানা যাচ্ছে, পাকস্থলীর আলসার সৃষ্টিতে হেলিকোব্যাকটর পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার সরাসরি ভূমিকা অথবা বিশেষ অবদান রয়েছে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে আলসার সারিয়ে তোলা সম্ভব। রসায়নাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, রসুন হেলিকোব্যাকটর পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া মারতে পারে। তবে শরীরের অভ্যন্তরে এই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে সঙ্ঘাতে রসুনের অবদান তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। সম্ভবত এই কারণে যে, রসুনের সক্রিয় উপাদানগুলি আমাদের মুখের লালা বা পাকস্থলীর জারক রসের অম্লের সঙ্গে বিক্রিয়ায় অন্য কোনও যৌগে পরিণত হয়। তবে রসুন কোয়া থেঁতো করে ১০ মিনিট অপেক্ষার পর গ্রহণ করলে ভিন্ন ফল মেলে কারণ ওতে তখন বেশি পরিমাণে অ্যালিসিন থাকে। বাস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ গোসালা সাভিম পরীক্ষাগারে প্রমাণ করেছেন, অ্যালিসিনের সঙ্গে পরিচিত কোনও অ্যান্টিবায়োটিক মেশালে যে-ফল পাওয়া যায়, সেই ফল অ্যালিসিন বা অ্যান্টিবায়োটিক এককভাবে কাজ করে দিতে পারে না। নাশভিলের ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মার্টিন রেসার প্রমাণ করেছেন ক্রোন’স ডিজিজ আলসারেটিভ কোলাইটিস ও বিভিন্ন প্রদাহের মূলে রয়েছে মাইকোব্যাকটেরিয়াম প্যারাটিউবারকুলেসিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া। এ প্রসঙ্গে রসুনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। বলা হচ্ছে, যদি কেউ প্রতিদিন ২-৪ কোয়া কাঁচা রসুন খেয়ে চলেন তবে ছয় মাস বাদে তাঁর স্পর্শকাতর কোলন থাকা সত্ত্বেও হজমের গন্ডগোল সেরে যাবে। ধমনীতন্ত্রে প্লেক জমার ফলে করোনারি আর্টারির অসুখ হয়। দেখা গেছে, এই প্লেকের মধ্যে সাধারণ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে সাইটোমেগালো ভাইরাস এবং ক্ল্যামাইডিয়া নিউমোনিয়া ব্যাকটিরিয়া থাকে। বার্লিনের হামবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চলতি গবেষণা থেকে জানা গেছে, রসুন গ্রহণের ফলে ৫৪ মাসের জন্য নির্ধারিত একটি পরীক্ষায় ১৮ মাসের মধ্যে অ্যাথেরোস্ক্লেরেসিস মাত্রা কমতে শুরু করেছে এবং প্লেকের নতুন নির্মান রোধ করা গেছে। বহুবিধ পরীক্ষায় ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে, রসুন এল ডি এল কোলেস্টেরল মাত্রা কমায়। যাঁরা নিয়মিত রসুন সেবন করে থাকেন তাঁদের ধমনীর নমনীয়তাও আশ্চর্যজনকভাবে বেশি।

এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে, রসুনের যখন এতো গুণই রয়েছে তখন আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সকেরা তাঁদের রোগীকে রসুন গ্রহণের সুপারিশ করছেন না কেন? বহু দেশে এই সুপারিশ করা হলেও অধিকাংশ দেশে করা হয় না সম্ভবত চারটি কারণে।

প্রথমত, আধুনিক চিকিত্সা শাস্ত্রে ভেষজ ওষুধ নিয়ে বিশদে পড়ার সুয়োগ নেই। দ্বিতীয়ত, ডাক্তারের রসুনের উপযোগিতা সম্পর্কে এখনও সেভাবে ওয়াকিবহাল নন বলে একে হাতুড়ে চিকিত্সার সমতুল্য বলে মনে করেন। তৃতীয়ত, আর্থিক কারণেই ওষুধ কোম্পানিগুলি রসুন ব্যবহারে উত্সাহ দেয় না। চতুর্থত, আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারেরা উপযুক্ত পুষ্টি, আহার ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রার মাধ্যমে রোগ সুরক্ষার চেয়ে রোগলক্ষণ উপশম ও প্রয়োজনে শল্য চিকিত্সায় জোর দিয়ে থাকেন।

ভেষজ বা সনাতনী চিকিত্সা উপাদান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আধুনিক ওষুধ কোম্পানীগুলি সর্বদা একটি ‘জাদু উপাদান’-এর খোঁজ করতে থাকে। তারা মনে করে কোনওভাবে যদি ওই আশ্চর্য সূত্রটি খুঁজে করা যায় তবে পরীক্ষাগারে সেটি কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করে ভাল মুনাফা করা যাবে। প্রয়োজনে উপাদানটির ঘনত্ব বাড়িয়ে দাবি করা হবে যে, এর ফলপ্রসূতা স্বাভাবিক ভেষজটির চাইতেও বেশি। কিন্তু সব সময় তারা যা চায় তা হয় না, সেটাই আনন্দের। দেখা গেছে, পেট্রোলিয়াম থেকে প্রাপ্ত ডাই অ্যালাইল ডাই সালফাইড-এর কাজ করার ক্ষমতা কাঁচা রসুনের চেয়ে অনেক কম। এটা সম্ভবত রসুন মধ্যস্থ উদ্বায়ী পদার্থের সঙ্গে ডাইঅ্যালাইল ডাইসালফাইডের বিক্রিয়ার জন্য হয়ে থাকে। এই উদ্বায়ী উপাদানগুলিই রসুনের অতিক্রিয়ার মূলে রয়েছে যা কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত উপাদান দিতে পারে না। ১৯৯৬ সালে আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিটা-ক্যারোটিন ট্যাবলেট খাওয়ার ব্যাপারে তাদের পূর্ববর্তী সুপারিশ তুলে নিতে বাধ্য হয়। কারণ তারা পরীক্ষা করে দেখে, স্বাভাবিক খাবারে যে পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন রয়েছে তা ট্যাবলেটের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। তখন তারা এই সিদ্ধান্তে আসে যে, স্বাভাবিক খাবারে বিটা ক্যারোটিনের সঙ্গে অন্য যে-সব উপাদান রয়েছে এই কার্যকারিতার পেছনে তাদেরও একটি ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ এটা একটা যৌথ বা মিলিত অবদান। বিটা-ক্যারোটিন এককভাবে এই কাজ করতে অপরাগ। রসুনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রসুনের গুণপনার জন্য যে অ্যালিসিন দায়ী তার একক কর্মক্ষমতার চেয়ে রসুনে উপস্থিত অন্যান্য উপাদান ও অ্যালিসিনের যৌথ ক্ষমতা অনেক বেশি। রসুনের ফলপ্রসূতা মাপতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন রসুনের মধ্যে ক্ষমতার পার্থক্য রয়েছে। রসুনের ক্ষমতার পেছনে চাষের জমির ধরন, আবহাওয়া, রক্ষণাবেক্ষণের শর্ত, কোয়ার আয়তন, কত দিন হল মাটি থেকে তোলা হয়েছে এইরকম বেশ কিছু কারণ রয়েছে। রসুন সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় যে এখনও আসেনি তার আর একটি বড় কারণ বোধহয় এই যে, বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর মারণ রোগ এইডস নিয়ন্ত্রণেও এই ‘বিষ্ময় ভেষজ’ কাজে লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আশার কথা, এই নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। সাফল্যের কয়েকটি ধাপের কথা শোনা গিয়েছে মাত্র।

কৃতজ্ঞতা- 1) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় 2) ছবির জন্য গুগল।

( লেখাটি ‘আজকাল সুস্থ’ পত্রিকায় ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে শীর্ষকোণের লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়। )

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url