বিখ্যাত কয়েকজন লেখকদের ‘লেখক’ হয়ে উঠার গল্প
১.
ক্লাসের ফাঁকে কয়েকজন তুমুল তর্ক করছে। নতুন লেখকদের লেখা নাকি সম্পাদকরা পড়েন না, এজন্য তারা ছাপেন না। প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক ছেলে সেই কথা মানতে রাজী না। সে বললো, “নতুন লেখকদের লেখা ভালো না বলেই সম্পাদকরা ছাপেন না। ভালো গল্প পেলে তারা অবশ্যই ছাপবেন।”
বন্ধুরা মানতে রাজী না। তারা বললো, “তাহলে বাজি ধর আমাদের সাথে, তুই লিখে দেখা।” কলকাতার সবচেয়ে ভালো পত্রিকা ‘বিচিত্রা’। বাজি ধরা হলো প্রবোধ কুমার ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় একটা গল্প পাঠাবেন এবং গল্পটি ছাপা হবে।
অঙ্কের বই সরিয়ে প্রবোধ কুমার গল্প লেখা শুরু করলেন। এক রাতের মধ্যেই গল্পটি লিখে ফেললেন। নাম দিলেন ‘অতসী মামী’। পৌষ সংখ্যা বিচিত্রা (ডিসেম্বর ১৯২৮), গল্পটি ছাপা হলো। প্রবোধ কুমার বাজি জিতে গেলেন। গল্প লেখার সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন – মানিক। আমরা যাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নামে চিনি, তার লেখালেখির যাত্রা ছিলো এই বাজি ধরে।
২.
বাংলা ভাষার এক কবিকে একসময় ডাকা হতো ‘ বা কবাকুম কবি’ বলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার এম. এ. পরীক্ষায় তার রচনার অংশবিশেষ তুলে ধরে বলা হতো- “শুদ্ধ বাংলায় লিখো।” ১৯১৩ সালে সেই কবি যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেই কবিকে সমাবর্তনের বিশেষ বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তিনিই প্রথম বেসরকারি ব্যক্তি, যিনি এই সম্মান পেলেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের চিরাচরিত প্রথা ভেঙ্গে তিনি বক্তৃতা শুরু করেন বাংলা ভাষায়।
যার ভাষাকে ‘সহীহ’ না বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় ব্যঙ্গ করতো, সেই বিশ্ববিদ্যালয় শেষমেশ গুণী রবীন্দ্রনাথকে কোলে তুলে নেয়।
৩.
জীবনানন্দ দাসের ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ার পর মীর আব্দুস শুকুর নামে মোল্লা বাড়ির এক ছেলে ভাবলেন, “আরে, এমন কবিতা তো আমিও লিখতে পারি।” কাঁচাহাতে একটা কবিতা লিখলেন। কবিতাটি এবার কাকে পড়াবেন? চাচাতো বোন হানুকে পড়তে দিলেন।
বেচারী তরুণ কবির কবিতাটি পড়ে বললো, “এটা তো আগে কোথাও পড়েছি।” কী এক অপমান! তিনি অপমান হজম করে নিলেন। তারমান, তাঁর প্রথম কবিতা পড়েই যদি সে বলে এতা গুণী কবিদের মতো, তাহলে তো তিনি কবিতা লিখতে পারবেন। তিনি বলে বসলেন- ‘আমি একজন কবি হবো’। সেই থেকেই তাঁর কবি হবার যাত্রা শুরু। এই মীর আব্দুস শুকুরকে আমরা কী নামে চিনি জানেন? কবি আল মাহমুদ।
৪.
পাশের বাড়ির অর্পণা নামের এক মেয়েকে ভালোবাসেন সুনীল নামের এক ছেলে। একদিন খেয়াল করলেন, সেই বাড়িতে ‘দেশ’ পত্রিকা যায়। তারমানে, ঐ বাড়ির লোকেরা ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ে। অর্পণাও নিশ্চয় পড়ে?
তিনি একটা কবিতা লিখে পাঠালেন দেশ পত্রিকায়। কবিতাটি প্রকাশ হয়েছে কি-না তিনি জানেন না। পত্রিকা কে না র মতো টাকাও তার কাছে নেই। একদিন দেখলেন, অর্পণা তার কাছে আসছে। হাতে একটা পত্রিকা। সে বললো, “এই সুনীল, আজ ‘দেশ’ পত্রিকায় তোমার নামে নাম এক নতুন কবির একটি কবিতা বের হয়েছে। কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’। পড়ছো?”
সুনীল মনে মনে বললেন, “সেই সুনীল তো আমি। আর একটি চিঠি কবিতাটি তো তোমার জন্য।” এই হলেন সেই সুনীল, যাকে আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে চিনি। তার জীবনের প্রথম কবিতাটি ছিলো একট চিঠি পৌঁছানোর জন্য। এখন তিনি কতো মানুষের চিঠির ভাষা হয়ে গেছেন!
৫.
এক তরুণ কবি খুব উৎসাহ নিয়ে তার প্রথম কাব্য সংকলন বের করছেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তার বইটি পরিচিতরা বাদে আর কেউ কিনে নি। খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। একসময় তার জীবনে আসলেন ফ্যানি ব্রন নামের এক প্রাণোচ্ছল সুন্দরী। তিনি ফ্যানিকে কবিতা পড়ে শুনাতেন। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ফ্যানি ব্রনকে উদ্দেশ্য করে লিখা।
সেই কবিতাগুলো তাঁকে ‘কবি’ খ্যাতি এনে দেয়। তিনি পরিচিতি লাভ করেন ‘Poet of Beauty’ বা সৌন্দর্যের কবি নামে। এই কবিকে আমরা চিনি জন কিটস নামে।
৬.
গতকাল আমার প্রিয় একজন মানুষ আমার জন্য একটা দু’আ করেন। তিনি বলেন, “আপনার জীবনে এমন একজন আসুক, যে আগুন নয়, আপনার জীবনে আলো হয়ে আসে।” এই দু’আটি পড়ে মনে হলো, আচ্ছা, আমার জন্য এরচেয়ে সুন্দর দু’আ কি কেউ কখনো করেছেন?
একজন লেখকের জীবনে তার বউয়ের ভূমিকা কেমন, সেটা নিয়ে কয়েকবছর আগে একটা রিসার্চ করেছিলাম। সেই রিসার্চে দেখিয়েছিলাম, প্রত্যেক ভালো লেখকের জীবনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তার স্ত্রী। স্ত্রীর প্রভাব একজন লেখকের লেখার মধ্যে ফুটে উঠে।
যেমন সক্রেটিসের ছিলো একজন বদমেজাজী স্ত্রী। তার স্ত্রীর নাম ছিলো Xanthippe. ইংরেজিতে Xanthippe মানে হলো রাগান্বিত মহিলা। সক্রেটিসের স্ত্রীর নামটাই হয়ে গেছে রাগান্বিত মহিলার প্রতীকী নাম। তিনি কতোটা বদমেজাজী ছিলেন একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন।
একবার সক্রেটিস ঘরে বসে পড়ালেখা করছেন। তার স্ত্রীর মেজাজ খটখট করছে। এই অকর্মা লোকটাকে তার সহ্য হয় না। Xanthippe ঝগড়া শুরু করে দিলেন। সক্রেটিস পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘরের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা করতে লাগলেন। এটা দেখে তো Xanthippe আরো রেগে গেলো। তারমানে তার কথা স্বামী কানে নিচ্ছেন না?
সে এক বালতি নোংরা পানি নিয়ে সক্রেটিসের মাথায় ঢেলে দিলো। সক্রেটিস মুখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘After a thunder, comes the rain’ অর্থাৎ, এতোক্ষণ ধরে মেঘের গর্জন হয়েছিলো, এবার বৃষ্টি পড়লো!
...
জন কিটসের জীবনে ফ্যানি ব্রাউনের কথা বলি, রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃণালিনীর কথা বলি কিংবা আইনস্টাইনের জীবনে এলসার ভূমিকা বলি, সবগুলো কিন্তু একই বৃত্তে গাঁথা। একজন লেখক হতে শুধুমাত্র জীবনসঙ্গী পেলেই হবে না, জীবনসঙ্গীকে ‘চিন্তাসঙ্গী’ হতে হয়।
জর্জ বার্নাড শ’ জীবনে অনেকগুলো নাটক, উপন্যাস লিখেছিলেন। ১৮৭৯-১৮৮৫, এই পাঁচ বছরেই লিখেন পাঁচটি উপন্যাস। কিন্তু, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, নাটক লিখেছেন বিয়ের পর। তার চিন্তাসঙ্গী ছিলেন চার্লোট পেইন টাউনসেন্ড।
বার্নাড শ’র জীবনে চার্লোটের ভূমিকা নিয়ে তিনি লিখেন, “যে গাছে ফুল ফোটে সে গৌরব গাছের। কিন্তু, যে সযত্নে গাছকে বাঁচিয়ে রাখে, তার কী প্রাপ্য? ফুলের জীবনে মালীর যে ভূমিকা, আমার জীবনে চার্লোটের সে ভূমিকা।”
(লেখাটি একটু বড় হয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ করে নিচ্ছি। কয়েকটা গল্প থাক অন্য কোনো সময়ের জন্য।)
...
লেখালেখির কৌশল পড়ে কি কেউ লেখক হতে পারে? হুমায়ূন আহমেদকে একবার একজন লেখালেখির কৌশল শেখানোর জন্য বললে তিনি বললেন, “লেখালেখির কৌশল পড়ে কেউ যদি লেখক হতে পারতো, তাহলে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হতেন তার ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ তাকে চিনে কয়জন?”
আমি এটাকে আরেকটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। ‘লেখালেখির কৌশল’ হলো কাচ্চি-বিরিয়ানীতে সালাদের মতো। কিন্তু যারা লেখালেখির কলাকৌশলকেই মনে করেন কাচ্চি-বিরিয়ানী, এগুলো পড়েই লেখক হয়ে যাবেন, তাহলে আপনার আর লেখক হওয়া হবে না।
পরের এবং শেষ পর্বে যা নিয়ে আলোচনা করবো:
। আমার নিজের লেখালেখির স্টাইল ।
----
|| লেখালেখির কলাকৌশল (তৃতীয় পর্ব) ||
© আরিফুল ইসলাম
২০ মে ২০২০